রবিবার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:৩৫ অপরাহ্ন
খলিলুর রহমান- নিজস্ব প্রতিনিধিঃ
রহিমাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মানব শেখরের বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম-স্বেচ্ছাচারিতা ও কর্মে ফাঁকির অভিযোগ এনে তার অপসারণের দাবিতে সন্তানদের বিদ্যালয়ে পাঠাচ্ছেন না অভিভাবকরা।
লিখিত ও অভিভাবকের অভিযোগে জানা গেছে- স্কুলের হাজিরা রেজিষ্টারে প্রধান শিক্ষক মানব শেখরের নিয়মিত উপস্থিতি থাকলেও বেশিরভাগ দিনই স্কুলে অনুপস্থিতি থাকেন।
শিক্ষকরা সপ্তাহে দুই-একদিন বিদ্যালয়ে এসে পুরো সপ্তাহের স্বাক্ষর করেন। প্রধান শিক্ষকের এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন দায়িত্ব পালনের সুযোগে অন্যান্য শিক্ষকগণ পাঠদান এবং স্কুলে আসা-যাওয়া করছেন খেয়াল খুশিমত। এ কারণে বিদ্যালয়টিতে ধীরে ধীরে শিক্ষার্থীর উপস্থিতি শূন্যের দিকে যাচ্ছে।
সরকারি নির্দেশনায় প্রতিদিন পাঠদানের আগে ছাত্র/ছাত্রীদের সমাবেশ, শপথ ও জাতীয় সংগীত বাধ্যতামূলক হলেও দীর্ঘদিন ধরে জাতীয় সংগীত ও সমাবেশ হচ্ছে না।
২৩শে অক্টোবর ২২ তারিখ সকাল ৯টায় সরেজমিনে রহিমাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গনে গেলে দেখা যায় ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ ঝাড়ু দিচ্ছে, কেউ কেউ খেলাধুলা করছে।
প্রতিনিধির উপস্থিতি টের পেয়ে প্রধান শিক্ষক ও অন্যান্য শিক্ষকদের ফোন দিয়ে স্কুলে তাড়াতাড়ি আসতে বলেন শিক্ষিকা কণিকা রানি। তড়িঘড়ি করে মাত্র দশ থেকে পনের জন শিক্ষার্থী নিয়ে একাই ছাত্রছাত্রী সমাবেশ (পিটি ক্লাস) শুরু করেন।
রহিমাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকা কণিকা রানিকে অন্যান্য শিক্ষকদের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন- অনেকেই দূর দূরান্ত থেকে আসেন, আবার কেউ কেউ রংপুর থেকে আসেন। তাই একটু বিলম্ব হয়।
প্রায় সাড়ে ৯টায় বিদ্যালয়ে আসেন শিক্ষকা সুচিত্রা রানী।দেরি করে আসার কারন জানতে চাইলে তিনি জানান- আমি যখনই আসি আর যাই না কেন আগমনের সময় ৯.০০ টা আর প্রস্থানের সময় ৩.১৫ লিখতে হবে ।
সহকারি শিক্ষিকা শ্যামলী রানী গত ১১ই থেকে ১৩ই অক্টোবর ছুটিতে, আবারও ১৯ ও ২০ অক্টোবর স্কুলে অনুপস্থিত ছিলেন। ২৩ তারিখে বিদ্যালয়ে আসেন শ্যামলী।
কিন্তু ২১ ও ২২ তারিখের উপস্থিতি ঘরে সিএল লেখা ছিলনা। প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে ওই ২ দিনের ফাঁকা ঘরে আগমন ও প্রস্থানের সময় লিখতে না পেরে ক্ষেপে যান শ্যামলী রানী।
প্রতিবেদকের সামনেই খসখস করে আগমন ও প্রস্থানের মোট ৯ দিনের সময় ও স্বাক্ষর লিখলেন আরেক শিক্ষিকা কণিকা রানী। সব দিনই আগমন ৯.০০ টায় ও প্রস্থান ৩.১৫ মিনিটে লিখলে প্রতিবেদক তার কাছে জানতে চায়, আপনি এক দিনেই ৯ দিনের স্বাক্ষর করলেন কেন ? আবার সবদিনেই একই সময়ে এসেছেন-গিয়েছেন তা কিভাবে আপনার মনে থাকল? কণিকা রানী জানান, আমাদের সকল সহকর্মীরাও একই ভাবে যাওয়া-আসার সময় লেখেন। তাই আমিও লিখি।
প্রতিবেদকদের দেখে তড়িঘড়ি করে হাজিরা রেজিষ্টারে আগমন ও প্রস্থানের সময় লিখতে গিয়ে পরবর্তী দিনের অর্থাৎ ২৪ তারিখের সহ স্বাক্ষর করে ফেললেন দুই শিক্ষক সুচিত্রা রানী ও কণিকা রানী।
উপস্থিতি রেজিষ্টারে নিয়মিত উপস্থিত অনুপস্থিত শিক্ষকদের তদারকি করা ও সি এল লেখার বিষয়ে অনীহার কারণ জানতে চাইলে ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মানব শেখর বলেন- আসলে শ্যামলী রানী আসেননি তা আমার মনে ছিল না। তাই লেখা হয়নি। পরের দিনও মনে ছিল না লিখতে। আসলে বয়স হয়েছে তো তাই প্রায়ই লিখতে ভুলে যাই।
অভিভাবক মোঃ মানিক জানান- তাদের ছেলে-মেয়েরা বিদ্যালয়ে নিয়মিত উপস্থিত হচ্ছে। কিন্ত প্রধান শিক্ষকের প্রশাসনিক স্বেচ্ছাচারিতার কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুলে এসে পড়া লেখা বাদ দিয়ে খেলা-ধূলা, গল্প-আড্ডা আর সবজি বাগানে কাজ করে বাড়ি চলে যাচ্ছে।
অভিভাবক কমল কান্তি রায় বলেন- আমার শিশু শ্রেণীতে পড়া ৪ বছরের ছোট্ট ছেলেটি কয়েকদিন আগে বিদ্যালয় কক্ষের চটে বমি করেছিল। পরে
চট ধুইয়ে দিতে ডেকেছেন শিক্ষকরা। বাধ্য হয়ে আমি চটগুলো নদীতে নিয়ে গিয়ে ধুয়ে দেই।
শিক্ষক সুমিতা রানীর কাছে অভিভাবককে চট ধোয়ার জন্য বাধ্য করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন- আমি কি নিজে বমি করেছি, যার বমি তার অভিভাবক পরিস্কার করবে? প্রধান শিক্ষকের নির্দেশে আমি পালন করেছি মাত্র।
অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলে প্রধান শিক্ষক মানব শেখর তাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করেন এবং তাদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করার হুমকি দেন বলে জানান স্কুলের ভুক্তভোগী অভিভাবকরা।
তারা জানান- মানব শেখরের দুর্নীতি অনিয়ম অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে প্রথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, বিভাগীয় কমিশনার, বিভাগীয় উপরিচালক (প্রাথমিক শিক্ষা), ইউএনও বরাবর সুনির্দিষ্ট অভিযোগ দেয়া আছে।
প্রধান শিক্ষক মানব শেখর বলেন- আমার বিরুদ্ধে এলাকাবাসীর আনীত অভিযোগ মিথ্যা। আমি নিয়মিত বিদ্যালয়ের পাঠদান হতে উন্নয়ন কল্পে কাজ কনে থাকি।
উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আঞ্জুমান আরা বেগম বলেন- রহিমাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নানান অভিযোগ জেনেছি। দ্রুত তদন্ত সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনী ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
ইউএনও রাসেল মিয়া বলেন- রহিমাপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মানব শেখরের বিরুদ্ধে এর আগে তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আবারও অভিযোগ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।